বিগ ব্রাদার সব দেখার চেষ্টা করলেও, ছোট ছোট লড়াইগুলো একদিন জয়ী হবেই : সুমন সেনগুপ্ত

Guest post by SUMAN SENGUPTO

Data hacking, representational image, courtesy DNA

এক গুপ্তচর এসে পড়েছে আমাদের জীবনে, যে  আমাদের সমস্ত গতিবিধি, কথোপকথনের ওপর নজর রাখছে। আজকে আর নতুন করে নিশ্চিত বলে দিতে হবে না, কে বা কারা এই গুপ্তচরবৃত্তি করেছে  এবং তাঁদের এই গুপ্তচরবৃত্তির উদ্দেশ্যই বা কি ?  কারণ, সংবাদপত্রের খবরের দৌলতে এই গুপ্তচরের নাম, কিভাবে কাজ করে তা মোটামুটি আজকে বেশীরভাগ মানুষের নখদর্পনে বা বলা ভালো মুঠোফোনের দর্পনে। মুঠোফোন বা মোবাইল ফোনের উল্লেখ করার কেন প্রয়োজন হলো? কারণ এবারের গুপ্তচর এসেছে অন্যভাবে, মোবাইল ফোনের মাধ্যমে । যে সামাজিক মাধ্যম নিয়ে আমরা এতো আত্মরতিতে ব্যস্ত সেই সামাজিক মাধ্যমও যে সরকারের অঙ্গুলিহেলন ছাড়া চলবে না, তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। যে প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা কখনো কখনো আত্মতৃপ্তি লাভ করছি যে এই তো বেশ সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলা হলো, সেই প্রযুক্তিই ব্যবহার করা হচ্ছে আমাদের প্রতিটি কথা শোনার জন্য এবং তা হচ্ছে এবং হয়ে চলেছে সেই মুঠোফোনের মধ্যে দিয়েই।

ভারতের বেশ কিছু সাংবাদিক, বিরোধী বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতৃত্ব, নির্বাচন কমিশনের প্রধান, সিবিআইএর অধিকর্তা এমনকি শাসক দলের নেতা মন্ত্রীরাও এই গুপ্তচরের চোখ থেকে রেহাই পাননি। এই গুপ্তচরকে ইংরেজিতে স্পাইওয়ার বলে এবং যাঁরা এই স্পাইওয়ার বানিয়েছেন তাঁরা বলেছেন  কেন্দ্রীয় সরকারের কাছেই তাঁরা এই প্রযুক্তি বিক্রি করেছেন, কিন্তু সরকার এই বিষয়ে একটি কথাও বলেননি। অথচ বাস্তব হলো বহু মানুষের ফোন নম্বর পাওয়া গেছে যাঁদের ফোনে আড়িপাতা হয়েছে এবং তা কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ ছাড়া যে হয়নি তা সরকারও অস্বীকার করতে পারেনি। 

ভারতে এই গুপ্তচরবৃত্তির একটা দীর্ঘ ইতিহাস আছে, যা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিকেরা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। রোমিলা থাপারের প্রাচীন ভারতের ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে এই গুপ্তচরবৃত্তির। মৌর্য সাম্রাজ্যে গুপ্তচরবৃত্তি ছিল একটি প্রচলিত সরকারী কাজ। কৌটিল্য যে ‘অর্থশাস্ত্র’ লিখেছেন, তাতেও বিভিন্ন জায়গায় এই গুপ্তচরবৃত্তির কথা বলা হয়েছে। শুধু তাই নয়, এই গুপ্তচরেরা যাতে বিভিন্ন ছদ্মবেশ ধারণ করে এই কাজটি করেন সেই প্রস্তাবও ‘অর্থশাস্ত্রে’ দেওয়া হয়েছে। কখনও ভবঘুরে, কখনও সাধারণ নাগরিক, ব্যবসায়ী অথবা সাধু সন্ন্যাসী এমনকি দেহপোজীবিনী সেজেও এই কাজ করা যায় তার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে ওই বইতে। সম্রাট অশোক কিভাবে নিজের দেশের মানুষের মনোজগতে প্রবেশ করে সেখান থেকে খবর সংগ্রহ করতেন তারও পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা আছে ওই কৌটিল্যের বইতে। কি ভাবছেন তাঁর প্রজারা, তাঁদের মধ্যে কোথাও কোনও অসন্তোষ তৈরী হচ্ছে কি না, এই সমস্ত সংবাদ যদি শাসকের কানে না পৌঁছয়, তাহলে সমস্যার সমাধান হবে কি করে?

এখন প্রশ্ন আসে কোন সমস্যার সমাধানের কথা মৌর্য সাম্রাজ্যের সময়ে বা অর্থশাস্ত্রে ভাবা হয়েছিল? আসলে কোনও রাষ্ট্র কখনোই চায় না,  তাঁর অধীনস্থ কোনও নাগরিক বা প্রজার কাছে এমন কোনও তথ্য থাকুক যার মধ্যে দিয়ে সেই নাগরিক রাষ্ট্রের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। রাষ্ট্র কখনোই চায় না কোনও বিচ্ছিন্নতাবাদ বা সন্ত্রাসবাদ মাথা চাড়া দিক, তাই তাঁর কাছে যেন সমস্ত তথ্য থাকে সেই প্রচেষ্টা তাঁর আগেও ছিল, এখনো আছে। এমন কোনও প্রযুক্তি যদি দেশের কোনও নাগরিকের কাছে থাকে, যার মধ্যে দিয়ে একজন নাগরিকের কাছে রাষ্ট্রের চেয়ে বেশী তথ্য থাকে তাহলে রাষ্ট্রের কাছে তা সমস্যার, তাই সেই সমস্যা সমাধানের জন্য রাষ্ট্রকে গুপ্তচরবৃত্তির সহায়তা নিতে হয়। সেই জন্যেই কাশ্মীরে কোথাও যদি সরকারকে এড়িয়ে ড্রোন ক্যামেরা ব্যবহৃত হয় তাহলে তা রাষ্ট্রের চক্ষুশূল হয়ে ওঠে। অর্থশাস্ত্রে যার উল্লেখ আছে। সেই সময়ে গুপ্তচরেরা ছদ্মবেশে কাজ করতেন, এখনো তাই করা হয়। আগে কোনও একটি অবয়ব গ্রহণ করতেন এখন অবয়বহীন প্রযুক্তির সাহায্যে এই কাজটি করা হয়।

এই মুহুর্তে দেশের এক বৃহৎ অংশের নাগরিক নিজেরা ডিজিটাল হয়ে উঠছেন এবং ক্রমশ জড়িয়ে পড়ছেন রাষ্ট্র এবং বহুজাতিক সংস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সামাজিক মাধ্যমের এক গোপন জালে। বেশীর ভাগ মানুষই জানেন না, এই পরিস্থিতির থেকে বেরোনোর উপায় কি? হয়তো আগের বহু সরকারের আমলে এই রকম নজরদারির অভিযোগ উঠেছে, কিন্তু এই সময়ে যে ডিজিটাল ভারতে নাগরিকেরা বাস করছেন তা কি বহুলাংশে এই নজরদারি ব্যবস্থাকে আরও পাকাপোক্ত করছে না? নরেন্দ্র মোদীর জমানা কি আগের সেই অর্থশাস্ত্রে উল্লিখিত গুপ্তচরবৃত্তিকে সরকারিভাবে মান্যতা দিচ্ছে না? যদি খেয়াল করা যায় এই করোনাকালে নজরদারি আরও বেড়েছে, প্রথমে আরোগ্য সেতু, তারপর কোউইন মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন যাতে একটি ফোন নম্বর দিলেই যেকোনো নাগরিক জেনে যাচ্ছেন তাঁর পাশের নাগরিকটি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন কি না, কিংবা প্রতিষেধক নিয়েছেন কি না, তখন তো প্রতিটি নাগরিক হয়ে উঠছেন রাষ্ট্রের এক একটি চোখ। প্রতিটি মানুষ তাঁর সহনাগরিকের ওপর নজর রাখছেন, হয়ে উঠছেন একে অপরের শত্রু। প্রথমে বলা হয়েছিল যে করোনার প্রতিষেধক ঐচ্ছিক, কারণ এখন তার পরীক্ষাপর্ব চলছে, কিন্তু দেখা গেল বেশ কিছু সরকারী ও বেসরকারী  প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে যে যাঁরা প্রতিষেধক নেবেন না, তাঁরা হয়ে উঠবেন অস্পৃশ্য, তাঁদেরকে একঘরে করে দেওয়া হবে। কে করবে? না, সরকার সরাসরি এসে এই দাগিয়ে দেওয়ার কাজটি করবে না, সরকারের চোখ-কানেরা যাঁরা সরকারের হয়ে নজরদারি চালায়, তাঁরাই এই কাজটি করবে।

এক সময়ে বলা হতো, ‘বন্দুকের নলই রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস’। ২০১৯ এ দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছেন যে আজকাল আর এই শ্লোগানের তাৎপর্য্য নেই, আজকাল যে মানুষ রাষ্ট্র বিরোধী কার্যকলাপে যুক্ত তাঁকে চিহ্নিত করতে হবে, তাই আর কোনও সংগঠনের ওপর শুধু নয়, প্রতিটি ব্যক্তি মানুষ যাঁরা রাষ্ট্রবিরোধী কাজের সঙ্গে যুক্ত তাঁদের ওপর নজরদারি করতে হবে। আর এই সময়ে এখন ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’র ছদ্মবেশে যে কাজটি করা হয়ে চলেছে তাকে ‘সারভেইলেন্স ইন্ডিয়া’ বলা কি অতিশয়োক্তি  হবে?

এখন প্রশ্ন হচ্ছে কি করণীয়? এই নজরদারির মাকড়সার জাল থেকে কি বেরোনোর কোনও উপায় আছে? জর্জ অরওয়েল তাঁর বিখ্যাত ১৯৮৪ বইতে যে লিখেছিলেন যে কোনও স্থানই আর নিরাপদ নয়, সমস্ত চলাফেরা কথাবার্তা সব কিছুই যে রাষ্ট্র নজরে রাখছে, তা কি তাহলে সত্যি? কিংবা এডওয়ার্ড স্নোডেন, যিনি এই নজরদারি এড়িয়ে অন্যদেশে পালিয়ে গেছিলেন, তিনি কি বলেন এই বিষয়ে? ২০১৪ সালে স্নোডেন বলেছিলেন প্রযুক্তিকে তো আর পিছনো যায় না, দিনের পর দিন প্রযুক্তি ক্রমশ সহজলভ্য হবে আরও সস্তা হবে। এখন যদি কিছু না করা যায় তাহলে আমরা একটা নজরদারির রাষ্ট্রে খুব শীগগিরই প্রবেশ করবো, যেখানে একটি রাষ্ট্রের অপার ক্ষমতাবলে সে জোর করে নাগরিকদের সমস্ত তথ্য ছিনিয়ে নেবে, শুধু তাই নয় তারপর সে সেই মানুষটিকে লক্ষ্যবস্তুও বানাবে। তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ কি? আমরা কি এমন একটা সময়ের দিকে এগোচ্ছি, যেখানে রাষ্ট্র তাঁর নাগরিকদের সমস্ত কিছু জানবে, অথচ একজন ব্যক্তি নাগরিক রাষ্ট্র সম্পর্কে কোনও কিছুই জানতে পারবে না? তাহলে সেটাই কি হবে গণতন্ত্রের মৃত্যু? নাকি আমাদের ফিরে যেতে হবে এমন একটা পৃথিবীতে, যেখানে আমাদের একমাত্র শত্রু আমাদের মুঠো ফোন বা মোবাইল ফোন আমাদের নিয়ন্ত্রণ করবে না? আমরা কি পারবো, ওই জীবনে নিজেদের ফিরিয়ে নিয়ে যেখানে আমাদের বাঁচা, বা তার জন্য লড়াই করা বা যে কোনও সামাজিক আন্দোলন এই ডিজিটাল নজরদারি এড়িয়ে গড়ে তুলতে? তা যদি হয়, তাহলে যে রাষ্ট্র আমাদের মতো নাগরিকদের এই দিকে ঠেলে দিচ্ছে তাকে উৎখাতের লড়াই আগে করা জরুরী। তাঁরা যা কিছু ছিনিয়ে নিয়েছে, তা ফিরিয়ে আনার লড়াই আগে শুরু করতে হবে।

ছোট বেলার একটা গল্প, যাঁরা বাংলা জানেন, তাঁরা বেশীরভাগই হয়তো পড়েছেন বা শুনেছেন। গল্পটি হয়তো ছোটদের জন্য লেখা, কিন্তু বিষয়টি আজকের সময়ে অত্যন্ত বড়দের একটি বিষয়। গল্পটি উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর লেখা- ‘টুনটুনির গল্প’। যেখানে এক ছোট্ট টুনটুনি রাজাকে শুনিয়ে রাজপ্রাসাদের পাশের এক গাছের অন্তরাল থেকে বলে ‘রাজার ঘরে যে ধন আছে, টুনির ঘরে সে ধন আছে’, যা শুনে রাজার অহমিকাবোধে আঘাত লাগে। তখনই রাজা তাঁর সেনা, পাইক, বরকন্দাজ নামিয়ে সেই টুনটুনির বাসায় কি ধন আছে সেই খোঁজে লাগিয়ে দেয়। আসলে এটাই সেই ক্ষমতা দখলের লড়াই। একটি ছোট্ট টুনটুনি পাখির কাছে কি এমন তথ্য আছে, যে তথ্য রাজার কাছে নেই, এটাই আজকের সময়ে তথ্য দখলের লড়াই, যা আজকের রাষ্ট্র করছে। কোনও নাগরিকের কাছে যদি এমন কোনও তথ্য থাকে, যা রাষ্ট্রের কাছে নেই তখনই রাষ্ট্র গুপ্তচরবৃত্তি চালিয়ে হোক, বা জোর করে হোক সেই তথ্য আত্মগত করতে চায় এবং তার মধ্যে দিয়েই সে ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়। এটাই আসলে ক্ষমতা, কিন্তু সেই ক্ষমতার বিরুদ্ধে ছোট ছোট লড়াইও থাকে। টুনটুনির লড়াইও সেই ছোট লড়াই, যে লড়াই নিশ্চিত রাষ্ট্রের চোখ, বিগ ব্রাদারের চোখ এড়িয়ে একদিন জয়ী হবেই, তা গল্পেও যেমন প্রমাণিত হয়েছিল, বাস্তবেও নিশ্চিত হবে।

সুমন সেনগুপ্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুকার ও সমাজকর্মী।

We look forward to your comments. Comments are subject to moderation as per our comments policy. They may take some time to appear.

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s